কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নাম বলতে গেলে যেই কয়জন বিজ্ঞানীর নাম চলে আসে তাদের মধ্যে শ্রোডিঙ্গার অন্যতম। তার নামটা রসায়ন এবং পদার্থ বিজ্ঞানের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। 


টিউশনে একটা কথা আমি প্রায়শই বলতাম। বিজ্ঞানীদের কাজই হল একজন আরেকজনের ভুল ধরা। প্রতিনিয়তই এই ভুল ধরার জন্যেই কিন্তু চলে নতুন নতুন গবেষণা। আর বিজ্ঞানীদের গবেষণায় এগিয়ে যায় পৃথিবী। অবশ্য যদি সেটা মানবজাতি কল্যাণের কাজে ব্যবহার করতে পারে আর কি। শ্রোডিঙ্গার ভদ্রলোকও কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন না। 

রাদারফোর্ড পরমানু মডেলের ত্রুটি গুলো সংশোধন করেন বিজ্ঞানী বোর। তবে বোরের পরমানু মডেলও যে যথার্থ তা কিন্তু নয়। বোরের ত্রুটি সংশোধন করতে পরবর্তীতে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা পরমানু মডেলের আবির্ভাব। ১৯২৬ সালে শ্রোডিঙ্গার নামক ভদ্রলোক তরঙ্গ বলবিদ্যার একটি সমীকরণ উপস্থাপন করেন যা কিনা ‘শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণ’ নামে পরিচিত। এই সমীকরণের মাধ্যমে মোটামুটি ভাবে পূর্বের ত্রুটি গুলো দূর হয়। কোয়ান্টাম মেকানিক্স পদার্থ বিজ্ঞানের একটি চমকপ্রদ বিষয়। পদার্থ বিজ্ঞানে অবদান এবং শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণ প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রোডিঞ্জার সাহেব ১৯৩৩ সালে নোবেল পুরষ্কারও পেয়েছেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ‘প্যারালাল ইউনিভার্স তত্ত্ব, সম্পর্কে নিশ্চয়ই আমরা অনেকেই জানি। এই প্যারালাল ইউনিভার্স তত্ত্ব ব্যাখ্যা করার জন্য কোয়ান্টাম মেকানিক্সে শ্রোডিঙ্গারের একটু বহুলালোচিত পরীক্ষণ প্রচলিত রয়েছে। এটি শ্রোডিঙ্গারস ক্যাট এক্সপেরিমেন্ট অথবা ‘শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল পরীক্ষা’ নামে সর্বাধিক পরিচিত। 



বিজ্ঞানী শ্রোডিঙ্গার


Photo courtesy: britannica.com

আমি পদার্থ বিজ্ঞানের মানুষ নই। তাই ওত গভীরে যাবো না৷ গভীরে যেতে চাইলেও হয়তো পারবো না। রসায়নের মানুষ হলেও জ্ঞানের পরিধি খুবই সীমিত। সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি। এই পরীক্ষণের  মুল বিষয় বস্ত হল সহাবস্থান। অর্থাৎ একই সাথে দুটো বিপরীত অবস্থা বিরাজ করা সম্ভব, যতক্ষণ তাকে দেখা হচ্ছে না৷ এই তত্ত্বকে বলা হয় ‘কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রিটেশন তত্ত্ব। বিজ্ঞানী নিলস বোর এবং ওয়ার্নার কার্ল হাইজেনবার্গ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উপর ভিত্তি করে আণবিক পর্যায়ে বস্তুর আচরণ নিয়ে এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এই তত্ত্ব মতে, কোন কোয়ান্টাম কণা একটি নিদিষ্ট মুহূর্তে একই সাথে কণা হিসেবে এবং তরঙ্গ হিসেবে থাকতে পারে। একে কণার দ্বৈত চরিত্র বলে। কণার এই সব রকম অবস্থার সমন্বয়কে একত্রে বলা হয় কোয়ান্টাম সুপারপজিশন। কী? ভাবতে অবাক লাগছে তাই না? কিন্তু এটা আমার কথা নয়।  স্বয়ং অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী শ্রোডিঙ্গার ১৮৩৫ সালে এটি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমান করে দেখিয়েছেন

ধরা যাক, একটি বিড়াল কে একটি বাক্সে বন্ধ করে রাখা হল। এবার সেখানে একটি তেজস্ক্রিয় পদার্থ রাখা হল, যার অর্ধ জীবন অথবা হাফ লাইফ এক ঘন্টা। (কোনো তেজস্ক্রিয়  পদার্থ ক্ষয় হয়ে প্রাথমিক ভরের অর্ধেক ভরে পরিণত হতে যেই সময়ের প্রয়োজন তাকে বলা হত অর্ধ জীবন অথবা হাফ লাইফ)। এবার এমন একটা ব্যবস্থা তৈরি করা হল, যাতে করে মৌলটি যেই হাফ হয়ে যাবে, একটা হাতুড়ি একটা বিষাক্ত গ্যাসে ভরা কাঁচের পাত্রে আঘাত করে তাকে ভেঙে ফেলবে। এবং গ্যাসের বিষক্রিয়ায় বিড়ালটি মারা যাবে। এরপর বাক্সটি বন্ধ করে দেওয়া হল। 



শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল পরীক্ষা


                                                        Photo Courtesy: rms.com

এবার একটু চিন্তা করুন তো এক ঘন্টা পর বাক্সটি খোলার ঠিক আগে বিড়ালটি কেমন অবস্থায় থাকবে? ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন তাই তো? হওয়ারই কথা। আমাদের মত সাধারণ মানুষের মাথায় এসব না আসাটাই স্বাভাবিক।কিন্তু শ্রোডিঙ্গারের মাথায় এসেছিল। তিনি বলেন, বিড়ালটি এই মুহুর্তে জীবিত এবং মৃত, দুই অবস্থাতেই থাকতে পারে। বাক্সটি খোলার পর যখন তাকে পর্যবক্ষন করা হবে, সেই পর্যবেক্ষনই ঠিক করে দেবে, বিড়ালটি শেষ মেশ কোন অবস্থায় থাকবে। মোট কথা যদি বাক্সের ভেতর তেজস্ক্রিয় বিকিরণ হয়ে থাকে তাহলে বিড়ালটি মারা যাবে আর তেজস্ক্রিয় বিকিরণ না হলে বিড়ালটি জীবিত থাকবে। অর্থাৎ এই পরীক্ষা অনুসারে বিড়ালটি জীবিত এবং মৃত দুই অবস্থাতেই থাকার সম্ভাবনা আছে। আর এমন জীবন্মৃত থাকার কারণে অনেকে একে ‘জম্বি ক্যাট তত্ত্বও বলে থাকেন। 



শ্রোডিঙ্গারের বিড়ালের জীবিত এবং মৃত অবস্থায় কাল্পনিক ছবি 


 Photo Courtesy: livescience.com




এই পরীক্ষা জন্ম দেয় পদার্থবিদ্যার সবচেয়ে জটিল শাখা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের । অনেকের কাছে জটিল নাও মনে হতে পারে। অন্তত আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের জন্য মোটামুটি ভাবে দূরহ ব্যাপারই বলা চলে। কোয়ান্টাম মেকানিক্স কতটা কঠিন তা নিচে প্রদত্ত উক্তিটি থেকে কিঞ্চিত অনুমেয়।


“If you think you understand quantum mechanics, you don't understand quantum mechanics.”

অনুবাদঃ “আপনি যদি মনে করেন যে আপনি কোয়ান্টাম মেকানিক্স বোঝেন তবে আপনি কোয়ান্টাম মেকানিক্স বুঝতে পারবেন না।”

~Richard P. Feynman


কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আশ্চর্য এই পরীক্ষা  বিড়াল, মানুষ, ফুটবল এর মত বড় বস্তুর ক্ষেত্রে কাজ না করলেও পারমাণবিক স্তরে দেখা যায়। কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকেই জন্ম হয়েছিল ‘মাল্টিভার্স বা প্যারালাল ইউনিভার্স তত্ত্বের। যেখানে এই মহাবিশ্বের মত অসংখ্য মহাবিশ্ব বিদ্যমান। আর সেই মহাবিশ্বে হয়তো আমরাও আছি, সম্ভাব্য সকল অবস্থা নিয়ে। 


বি.দ্রঃ "শ্রোডিঙ্গারস ক্যাট" পরীক্ষাটি  কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের অংশ নয়। শ্রোডিঙ্গারের পরীক্ষাটি কেবল একটি শিক্ষার সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কিছু লোক  কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছিলো। তাছাড়া কোয়ান্টাম তত্ত্বের কিছু ব্যাখ্যা বাস্তব জগতের সঙ্গে মেলে না। তাই এই ধারণা পরিস্কার করার জন্যই মূলত শ্রোডিঙ্গারের এই পরীক্ষা। 


সূত্রঃ

👉https://www.nature.com/articles/d41586-018-06749-8

👉https://www.scientificamerican.com/article/this-twist-on-schroedingers-cat-paradox-      has-major-implications-for-quantum-theory/

👉https://www.discovermagazine.com/the-sciences/schroedingers-cat-experiment-and-the-conundrum-that-rules-modern-physics

👉https://www.nationalgeographic.com/science/article/130812-physics-schrodinger-erwin-google-doodle-cat-paradox-science

👉https://www.newscientist.com/definition/schrodingers-cat/



আপনি যদি এই ব্লগে নতুন হয়ে থাকেন তাহলে আমার বাকি লিখা গুলো পড়ে নিতে পারেন। আর হ্যাঁ অবশ্যই কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না কেমন লাগলো। আপনার মন্তব্য আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। ধন্যবাদ। 😊



👉অপ্রয়োজনীয় প্রিয়জন

👉ছোট্ট বেলার বন্ধু

👉ভালবাসার শাস্তি

👉টার্নিং পয়েন্ট

👉এখানেই শেষ নয়!

👉নিশ্চুপ ভালবাসার গল্প

👉ভালবাসার শেষ প্রহর